লিয়াকত খান : মুক্তিযুদ্ধে শহীদ পরিবারের এক গর্বিত উত্তরাধিকার


admin প্রকাশের সময় : মে ২০, ২০২৫, ৫:৩০ পূর্বাহ্ন /
লিয়াকত খান : মুক্তিযুদ্ধে শহীদ পরিবারের এক গর্বিত উত্তরাধিকার

সিলেট বিডি ভিউ: মোহাম্মদ লিয়াকত আলী খান কমলগঞ্জ উপজেলার পতনঊষার গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহন করেন। তাঁর পিতা মরহুম মোহাম্মদ হাফিজ খান। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে যে সকল পরিবারের উপর অত্যাচার ও নির্মমতার বিভীষিকা নেমে আসে লিয়াকত খানের পরিবার হচ্ছে সেই সব পরিবারের একটি।

৭০’ এর নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৬ দফা ও ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ১১ দফার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে দেশের আপামর জনসাধারণের নিকট পৌঁছে দিতে প্রত্যন্ত অঞ্চলে বঙ্গবন্ধুর অনুসারী নেতা কর্মীরা ঝাঁপিয়ে পড়েন।পরিবারের উনার বড় ভাইয়েরা (নিজ ভাই ও চাচাতো ভাই ) সবাই স্বাধীনতাকামী ও আওয়ামীলীগপন্থী ছিলেন । এক ভাই মোঃ ইয়াওর আলী খান তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যয়নরত এবং সরাসরি ছাত্র রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত। আর্থিক ও সামাজিক ভাবে স্বচ্ছল এবং স্বাধীনতাকামী পরিবার হওয়ায় আওয়ামীলীগের মনোনয়ন প্রাপ্ত এম. এল এ পদপ্রার্থী কেন্দ্রিয় নেতা জনাব মো: ইলিয়াস নেতাকর্মী সহ কয়েকবার পতনঊষার ঠিকাদার বাড়ি” খ্যাত তাদের বাড়ীতে আসা যাওয়া করেন । স্বাধীনতার স্বপক্ষে এলাকায় জনমত গঠনে এবং নির্বাচনের প্রাক্ষালে ক্যাম্পেইনে এম.পি.এ পদপ্রার্থী জনাব আলতাফুর রহমানও একাধিকবার ঠিকাদার বাড়ীতে” ক্যাম্প করে স্থানীয় আওয়ামীলীগ নেতাকর্মীদের নিয়ে এলাকায় কাজ করেন । শুধু তাই নয় বিভিন্ন সময়ে দলীয় প্রচারনার কাজে বিপুল অর্থ সাহায্যও তাদের পরিবার থেকে করা হয় । লিয়াকত খানের যৌথ পরিবারের তখন ২ টি ট্রাক ও ১ টি জীপ গাড়ী সত্তরের নির্বাচনে দলীয় প্রচারনার কাজে ব্যবহার করা হয়। সত্তরের নির্বাচনী কাজে তাঁদের জীপ গাড়ীটি সার্বক্ষনিক ব্যবহারের জন্য দেওয়া হয় ।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে শুধু স্বাধীনতাকামী, মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে অবস্থান থাকার কারণে এবং সত্তরের নির্বাচনে সহযোগিতা করায় এই বাড়িটির উপর এক নারকীয় বিভৎসতা নেমে আসে ।
বিভিষিকাময় সেই দিনটি ছিল ১৬ই মে ১৯৭১সাল বাংলা ১লা জ্যৈষ্ঠ রোজ রবিবার। সেদিন পাকসেনারা এই বাড়িতে হানা দেয় এবং নির্মম অত্যাচারের মাধ্যমে বাড়িতে অবস্থানরত প্রাপ্ত বয়স্ক সকল পুরুষদের (মোট সাত জন) ধরে নিয়ে যায়। সেদিনের সেই বিভৎসতার একটি খন্ডিত চিত্র লিয়াকত খানের লেখা একটি কবিতার কিছু অংশ থেকে আমরা আঁচ করতে পারি-
“….হঠাৎ কটকট ভারী বুটের শব্দে সবার ঘুম ভাঙ্গল
ভীতসন্ত্রস্থ অসহায়ত্ব নিয়ে শুরু হলো ছুটাছুটি
‘বাহার নিকলো’ হুংকারে সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়লো উঠোনে
সবাইকে লাইন করে দু’পাশে দু’টি ষ্ট্যান্ড গান বসানো হলো
মুখোশপরা হায়নারা পাল্টালো খোলস
পূরুষদের আলাদা করে চললো পাশবিকতা !
বুটের লাথিতে থেঁতলে গেল ঠোঁট জোড়া
লাল রংয়ে ভিজে গেল উঠোন
দাঁত কয়েক ঝরে পড়লো সেই চির চেনা মাটিতে
মা’গো আল্লা’গো বলে চেঁচিয়ে উঠলেন আমার ভাইয়েরা
শিশু মন ভয়ে অজানা আতঙ্কে
মুখ লুকালাম মায়ের আঁচলে
ঘুমিয়ে পড়লাম নাকি জ্ঞান হারালাম
কিছুই পাইনি টের
স্তম্ভিত ফিরে দেখি বাড়ীটা ফাঁকা
চারিদিক পোঁড়া গন্ধ আর কান্নার রোল…”
একাত্তরে পাক হানাদারদের নির্মমতার শিকার হয়ে জনাব লিয়াকত খানের পরিবারের যারা শহীদ হন তাঁরা হচ্ছেন মোঃ আপ্তাব আলী খান, মোঃ ওয়াজেদ আলী খান ও মোঃ আক্তার আলী খান। কিছুদিনের মধ্যে পরিবারের বড় ভাই যৌথ পরিবারের প্রধান কান্ডারী মোঃ তজমূল আলী খান এই বিধ্বস্ততার ধকল সহ্য করতে না পেরে অকালেই ইন্তেকাল করেন। পরিবারের উপার্জনক্ষম সবাইকে হারিয়ে বিশাল পরিবার ও তাঁদের স্ত্রী, অপ্রাপ্ত বয়স্ক ছোটছোট সন্তানেরা অবিভাবক শূন্য হয়ে স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে কঠিন ও জঠিল পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়। অর্থনৈতিক ভাবে পরিবারটি স্বচ্ছল হলেও উপযুক্ত ও দক্ষ পরিচালকের অভাবে পরিবারটি বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। বৃদ্ধ বাবা ও চাচাদের তদারকিতে মুক্তিযুদ্ধকালে পাক হানাদারদের নির্মমতায় পরিপূর্ণ ভণ্ডুল হয়ে যাওয়া পরিবারটি এক সময় আবারও স্বাভাবিকতায় ফিরে আসতে থাকে। পিতৃহীন ছেলে মেয়েদের মানুষ করা,তাদের লেখাপড়া এমনকি জীবনে পরিপূর্ণ ভাবে প্রতিষ্ঠা করতে পরিবারের বেঁচে যাওয়া অন্যান্য সদস্যরা নিরলস পরিশ্রম করেন।
জনাব লিয়াকত খান তাঁদের বাড়ি সংলগ্ন পারিবারিক ভাবে প্রতিষ্ঠিত মাইজগাঁও সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষা জীবন শুরু করে পতনঊষার উচ্চ বিদ্যালয়ে এস এস সি ও শ্রীমঙ্গল সরকারী কলেজ থেকে গ্রাজুয়েশন করেন। বিধ্বস্ত পরিবারের হাল ধরতে অল্প বয়সেই জেমস্ ফিনলে টি এন্ড ল্যান্ডস কোম্পানীতে চাকুরি জীবন শুরু করেন। চাকুরি জীবনে কর্মক্ষেত্রে অত্যন্ত দক্ষতার স্বাক্ষর রাখেন এবং ১৯৯২ সালের শেষের দিকে এম আর খান চা বাগানে এ্যাসিষ্টেন্ট ম্যানেজার থাকা অবস্থায় যুক্তরাজ্যে ফাঁড়ি জমান। বর্তমানে তিনি ম্যানচেষ্টার শহরের একজন স্থায়ী বাসিন্দা।
যুক্তরাজ্যে তিনি পেশাগত কাজের পাশাপাশি বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব সুনামের সাথে পালন করে যাচ্ছেন। ৪৮ বছর আগে প্রবাসী বাঙ্গালীদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত গ্রেটার ম্যানচেষ্টার বাংলাদেশ এসোসিয়েশনের গত তিন টার্মের তিনি একজন নির্বাচিত সদস্য। বর্তমানে তিনি উক্ত প্রতিষ্ঠানের ট্রেজারারের দায়িত্ব পালন করছেন। ম্যানচেষ্টারে বাঙ্গালীদের প্রাণকেন্দ্র লংসাইট-এ অবস্থিত শাহপরান মসজিদ ও এডুকেশন সেন্টারেরও তিনি প্রতিষ্ঠাকালীন সময় থেকে বিগত ১৬ বছর ধরে কার্যনির্বাহী কমিটির একজন সদস্য। তাছাড়া বাঙ্গালী যুবসমাজকে খেলাধুলা ও বিভিন্ন সমাজ সচেতন মূলক কর্মকান্ডে উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা যোগাতে স্থানীয় ক্লাবের সাথেও তিনি সম্পৃক্ত।
দীর্ঘ দুই যুগেরও বেশী সময় ধরে তিনি প্রবাস জীবন কাটালেও তাঁর মন সবসময় দেশ ও দেশের মানুষের জন্য ব্যাকুল থাকে। দেশের অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানো, তাদের সাধ্যানুযায়ী দান-খয়রাত করা তাঁর নিত্যকার ব্যাপার। বিভিন্ন সামাজিক প্রতিষ্টান, স্কুল, মসজিদ, মাদ্রাসায় তাঁর অনুদান সর্বজন স্বীকৃত। দানশীলতায় পারিবারিক ঐতিহ্য বহনকারী জনাব খান মাইজগাঁও সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং পতনঊষার পোষ্ট অফিসের দাতা পরিবারের অন্যতম সদস্য। তিনি পতনঊষার উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজের একজন আজীবন দাতা সদস্যও বটে।
একজন লেখক ও কবি হিসাবে তিনি বন্ধুমহলে, দেশে ও বিদেশে বেশ সুনাম অর্জন করছেন। তাঁর লিখা কবিতা ,প্রবন্ধ ও নিবন্ধ প্রায়ই বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।
মুক্তিযুদ্ধের শহীদ পরিবারের সুযোগ্য উত্তরাধিকারী জনাব লিয়াকত আলী খান পারিবারিক জীবনে একজন সফল স্বামী ও একজন পিতা। তাঁর সহধর্মিনী জ্যোৎস্না খান তাঁর উৎসাহ, অনুপ্রেরণা ও সহায়তায় বৃটেনে কর্মব্যস্ততার মাঝে থেকেও একজন ভালো লেখিকা ও কবি হিসাবে সবার কাছে সমাদৃত। তাঁর তিন সন্তানের প্রত্যেকেই সু-স্বভাবজাত ,সদালাপী ও উচ্চ শিক্ষার্থে বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত।
ব্যক্তি জীবনে একজন ধার্মিক, সৎ,সদালাপী, বন্ধুবৎসল, সদাহাস্যজ্জল ও নৈতিক মানদন্ডে ব্যক্তিত্ব সম্পন্নের অধিকারী জনাব খান পরিচিত সবার কাছেই অতি প্রিয় একজন মানুষ।

তথ্য সূত্র: বৃটেন প্রবাসী কবি ও গবেষক ড. সৈয়দ মাসুম রচিত “বিলেতে কমলগঞ্জের শতজন” বই থেকে নেয়া।